প্রেমের একদিন প্রতিদিন

 

-      প্রেমের জন্য একটি দিন নিয়ে নয়, প্রেমের জন্য এই দিনটি, মানে ভ্যালেন্টাইন্স ডে নিয়ে রয়েছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-দোলাচল ও সংশয়। প্রেমের জন্য একটি দিন তো থাকতেই পারে। অনেকে বলে, প্রেম যদি থাকেই, তাহলে প্রতিদিনই থাকবে, বিশেষ একটা দিনেই কেন থাকবে? কিন্তু, আমাদের সমস্ত উৎসব-অনুষ্ঠান সম্পর্কেই তো এ কথা বলা যেতে পারে। আমরা তো রোজই ঈশ্বরের আরাধনা করি, তবু বিশেষ-বিশেষ তিথি বা পার্বণেও তো ঈশ্বরের আরাধনাকে উৎসবে আনন্দের পর্যায়ে নিয়ে যাই। পিতা-মাতা-শিক্ষককে আমরা রোজই সম্মান করি (মাঝে-মাঝে কোনও কারণে তাঁদের সঙ্গে বিবাদ-বচসা হলেও), তবুও কেন গুরুপূর্ণিমায় শিক্ষকদের বা বিজয়ায় বাবা-মাকে প্রণাম করার বিশেষ রেওয়াজ প্রচলিত। তাই প্রেম প্রতিদিন থাকলেও তার জন্য একটা বিশেষ দিন পালন করাই যায়। কিন্তু আমার প্রশ্ন এই দিনটি নিয়ে। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে উদারবাদী ও রক্ষণশীলতার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে আমাদের দেশে সেই গত শতাব্দির নব্বইয়ের দশক থেকে।



এই দিনটির সপক্ষে থাকা উদারবাদীরা দুই প্রকারের। এঁদের মধ্যে একদল মানসিক দিক দিয়ে উদার। তাঁদের মতে, ভারতে এই দিনটি পালন করার বিষয়টি বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও এ নিয়ে কোনও ছুঁতমার্গ না-রাখাই ভাল। পৃথিবীতে মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম উপাদানই হল আদান-প্রদান। মানব সভ্যতার প্রতিটি ক্ষেত্রে এই আদান-প্রদানের নিদর্শনের ছড়াছড়ি। আরেক দল হলেন অর্থনৈতিক উদারবাদী। একটা কথা তো মানতেই হবে, আমাদের দেশে গত শতাব্দির শেষ দশক থেকে ধীরে-ধীরে ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালনের উৎসাহ-উদ্দীপনা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার মূলে কিন্তু ছিল অর্থনৈতিক উদারবাদ।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালনে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ থাকলেও আমাদের দেশে কিন্তু তা একেবারে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য চালিত। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে গড়ে উঠল গ্রিটিংস কার্ড ও গিফ্টের এক নতুন বাজার। সেই বাজারে এক সময় রমরমিয়ে ব্যাবসা করেছে একটি মার্কিন ব্র্যান্ড। ভারতের যে কোনও শহরের বিভিন্ন স্থানে তাদের আউটলেট ছিল; এমনকী পাড়ার ছোট-বড়-মাঝারি ব্যাবসায়ীদের কাছেও থাকত ওই ব্র্যান্ডের পণ্য। আজ সেই ব্র্যান্ড আমাদের দেশ থেকে এক প্রকার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও সেই বাজারটা কিন্তু রয়ে গেছে। এমনকী আজও আমাদের দেশের ফুলওয়ালারা এই বিশেষ দিনটিতে কত যে গোলাপ ফুল বিক্রি করে, তার হিসাব আমার জানা নেই। তবে এই দিনটিকে কেন্দ্র করে ব্যাবসা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে, কারণ এই দিনটিকে আগের তুলনায় অনেক বেশি প্রেমিক-প্রেমিকারা পালন করতে শুরু করছে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, যে-কোনও উৎসবকে ঘিরেই তো বিশাল এক বাজার তৈরি হয়, তাহলে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র ক্ষেত্রেও তা হবে না-ই বা কেন? ঠিকই, তা হতেই পারে, বরং তা হয়ে গেছেও। কিন্তু পার্থক্য এখানেই যে, অন্যান্য উৎসব পালনের হাত ধরে অর্থনৈতিক বাজার গড়ে ওঠার বিপরীতে বাজার অর্থনীতি নিজেই ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র মতো একটা দিনকে পালন করতে শিখিয়েছে মানুষকে। বাজার অর্থনীতি নানা রকম ভাবে মানুষকে চালিত করে থাকে, তার অন্যতম উদাহরণ এই ভ্যালেন্টাইন্স ডে।

এই দিনটির বিপক্ষে আছেন সামাজিক রক্ষণশীলরা। সেই রক্ষণশীলতার হাত ধরেই এই দিনটির বিরোধিতা করতে গিয়ে উগ্র হয়ে উঠছে নীতি পুলিশের দল। দেশের কোথাও-কোথাও আবার তাদের কার্যকলাপ পেয়ে যাচ্ছে প্রশাসনিক সহযোগিতাও। সামাজিক রক্ষণশীলরা উদারমনাদের বিরুদ্ধে একেবারে বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে বলছেন, এইসব বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব থেকে আমাদের দেশের যুব প্রজন্মকে এবং আরও ব্যাপক অর্থে আমাদের দেশের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-পরম্পরাকে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু রক্ষকের দল যেভাবে প্রেমিক-প্রেমিকাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে; এই দিনটিকে যাতে কোনও ভাবেই পালন করা না-হয় তার জন্য ওই দল যে তাণ্ডব চালায়, তা তো একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে এবং মানবিক দিকে দিয়ে মেনে নেওয়া যায় না। যে কেউ নিজের প্রাণের মানুষের হাতে হাত ধরে বা কাঁধে হাত রেখে দেশের যে কোনও পথ ধরে হেঁটে যেতেই পারেন, কোথাও গিয়ে বসতেই পারেন, এমনকি নিরালায়-নিরিবিলিতে নিভৃত সময় কাটাতেই পারেন। তাঁদেরকে বাধা দিতে, লাঞ্ছনা করতে তেড়ে আসা নীতি পুলিশের দলকেও তো মেনে নেওয়া যায় না।

প্রেমের এই দিনটিকে কেন্দ্র করে বিবাদমান দুই পক্ষের— অর্থনৈতিক উদারবাদী ও সামাজিক রক্ষণশীল—কাউকেই মনে-প্রাণে সমর্থন করা যায় না। থাকা যায় শুধু প্রেমের সপক্ষে। স্বার্থ ও হিংসাকে ছাপিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠুক প্রেমের বিজয়-নিশান। প্রেমকে ঘিরে যুগে-যুগে বহু বাদ-বিবাদ হওযার পরেও প্রেম আত্মশক্তিতে নিজের মহানতা প্রকাশ করে গিয়েছে। লড়াই কখনও থেমে থাকে না, তাই প্রেমকেও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য লড়ে যেতে হবে প্রতিনিয়ত। বিপ্লব-বিদ্রোহ-ভালবাসায় পথের দিশা হারিয়ে গেলে গাওয়া যেতেই পারে—

     যদিও আকাশ ধোঁয়াশায় ম্রিয়মাণ

     তোমার জন্য গাইছি প্রেমের গান

© তাপস পাল

Comments

  1. "আমি চলে যাচ্ছি তোমার সিঁথির লাল এলোমেলো করে

    ওই দ্যাখো ওদিকে সূর্য যে ডুবে গেল ভীষণ জলে

    এত সাদা কোথায় ছিল এতকাল

    সবই কুড়িয়ে রেখে যেতে হল তোমার কোঁচড়ে"

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

GREAT BOYS STOP WARS