ভোজের উৎসব

ছবি: প্রাণকৃষ্ণ কর

উৎসব মানেই ভোজ। কিন্তু, শুধু ভোজই যে উৎসব হয়ে উঠতে পারে, তার সেরা উদাহরণ আমাদের দেশের মকর সংক্রান্তি। পশ্চিমবঙ্গ ও অসম, এই দু জায়গায় এই উৎসবে সামিল হওয়ার পর মনে হয়েছে, অসমের মজাটাই আলাদা। তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে, বা বলতে পারি, কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে সংক্রান্তি পালন তো লোকে করে, কিন্তু তাতে থাকে না উৎসবের মেজাজ।

অসমে ভোগালি বিহু নামে পরিচিত এই উৎসব শুরু হয়ে যায় সংক্রান্তির আগের দিনেই। যাকে বলা হয় উরুকা। শুধু খাওয়া নিয়েই উৎসবমুখর এক পরিবেশ। সারাদিন বাজার থাকে সরগরম। রোজকার বাজারের পাশাপাশি গুয়াহাটি শহরে ঢল নামে অগণন পসারির। সবাই নিয়ে আসে বিহুর অজস্র সম্ভার। তবে, এই বিহুর প্রায় সাতদিন আগে থেকেই শহরের নানা জায়গায় ছোট-ছোট মেলাও বসে। সেই মেলাগুলোতেও বিক্রি হয় বিহুর সম্ভার। কী এই বিহুর সম্ভার? মেলা হোক বা, রোজকার বাজার, বা অগণন পসারির পসার। সবেতেই থাকে পিঠের উপকরণ।

বিহু মানেই পিঠে। নতুন চাল, নতুন গুড়ের পিঠে। অসমে মূলত যে-চাল দিয়ে পিঠে বানানো হয়, সেটাকে বলে বন্নি চাল। আমার মনে হয়ছে, বাংলায় যাকে বিন্নি ধান বলে, অসমে সেটাই মনে হয় বন্নি। আমাকে কেউ-কেউ বলেছেন, বিন্ন চালও বন্নি চালের মতো একটু আঠালো হয়। সে যা-ই হোক। শুধু যে বন্নি চাল পাওয়া যায়, তা নয়, এমনি আতপ চালের গুঁড়োও বিক্রি হয়। অনেকে সেই চালের গুঁড়োও কিনে নিয়ে যান পিঠে বানানোর জন্য। এইসব পিঠের মধ্যে পুর হিসাবে দেওয়া হয় নারকেল কোরা বা তিল। তাই নারকেল ও তিলও বিক্রি হয় প্রচুর। স্বাভাবিক ভাবেই দাম হয় আগুন। এ ছাড়াও বিক্রি হয়, চিঁড়ে, মুড়ি, গুড়, দই। আরও বিক্রি হয় গুড়া সান্দহ। এটাও এক ধরনের চালের গুঁড়ো। এই চালের গুঁড়ো দিয়ে লোহার মতো শক্ত একটা পিঠে বানানো হয়, এবং উরুকার পরদিন খড়-বাঁশ দিয়ে তৈরি মেজি পোড়ানোর পর যে প্রসাদ দেওয়া হয়, তার মূল উপকরণই হল এই সান্দহ। অসমের মানুষ এই সান্দহ গরম চায়ে ঢেলে নিয়ে পরম তৃপ্তিতে খেয়ে থাকেন। অসমের পিঠে মানেই শুকান পিঠা, ভাপা পিঠা, চুঙা পিঠা, ঘিলা পিঠা, ভাজা পিঠা, ইত্যাদি। আর ওই যে বললাম লোহার ছোট বলের মতো শক্ত পিঠে।

কিন্তু ভোগালি বিহু মানে শুধু পিঠে নয়। এই বিহুর উরুকা র দিনে অসমের মানুষ চর্ব্য-চূষ্য-লেহ্য-পেয় খেয়ে থাকেন পেট পুরে। বাংলার মতো অসমের মানুষেরও প্রধান খাদ্য ভাত ও মাছ। এই শীতে নদী-খাল-বিল-পুকুর থেকে জালে তোলা হয় ইয়াব্বড় সব মাছ। চিতল, বোয়াল, পিঠিয়া, রুই, কাতলা। এক-একটা বাজারে ২০-২৫ কেজির মাছ ওঠে। কোন বাজারে কত বড় মাছ বিক্রি হল, তাই নিয়ে চলে আনন্দময় এক অলিখিত প্রতিযোগিতা। শুধু মাছই নয়। মাংসও আছে। মুরগি, পাঁঠা তো আছেই। এর পাশাপাশি বাজারে বিক্রি হয় হাঁস, পায়ড়া ও শুয়োরের মাংসও।

গ্রামে আবার মাছ কেনার পাশাপাশি পুকুর থেকে মাছ ধরারও আনন্দ দেখতে পাওয়া যায়। সেই কেজি-কেজি মাছ তোলার পর গ্রামের মানুষ তা-ই নিয়ে রাতে মেতে ওঠেন মহাভোজে। শহরে আবার দেখা যায় বাজার থেকে কেনা মাছ-মাংস নিয়েই ঘরোয়া পিকনিকের আসর। উরুকার রাতে একদিকে যেমন সবাই ব্যস্ত ভোজ নিয়ে; অন্যদিকে, বাড়ির রান্নাঘরে ঘরের মা-মেয়ে-বউরা একের পর এক বানাতে থাকেন হরেক কিসিমের পিঠে। শুধু খাওয়া নিয়েই এমন উৎসব আমি দেখিনি।

এই উৎসবের রং কলকাতায় দেখিনি আমি। এখানে সংক্রান্তি উপলক্ষে বাড়ি-বাড়ি পিঠে হয়। ব্যস ওইটুকুই। এর বেশি কিছু নয়। মাছ-মাংস সহযোগে ভুরিভোজের আয়োজন থাকে না। বাজারের সরগরম চেহারাও দেখা যায় না। লোকে নিরিবিলি পিঠের উপকরণ কেনাকাটা করেন। বাড়িতে পিঠে বানিয়ে খান, প্রতিবেশীকে দেন। ওইটুকুই। ভোগালি বিহুর মতো উল্লাস-উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা দেখতে পাওয়া যায় না।

বাঙালি কি পিঠে-পুলির পার্বণকে অত গুরুত্ব দেন না? আমার মনে হয়, এটা স্থান বিশেষের ব্যাপার। অসমেরই বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকাতেও দেখি এই পার্বণকে ঘিরে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখতে পাওয়া যায়। তবে কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চলে তার দেখে মেলে না কেন?

আমি এর পিছনে দুটো কারণ দেখতে পাই। একটা পরম্পরা ও অন্যটা পরিবর্তন।

বাঙালিরা আসলে নিরামিষ খেয়ে সংক্রান্তি পালন করে থাকে। তাই মাছ-মাংস প্রিয় বাঙালি ওই দিন ঠিক সেই ভাবে ভুরিভোজে মেতে ওঠে না। অন্য আরেকটা কারণ বলতে আমি যে পরিবর্তনের কথা বলেছি। সেটা হল নগরায়ণ। শ-শ বছর আগেই কলকাতা ও বাংলার নানা প্রান্তে নগরায়ণ খুব তাড়াতাড়ি শুরু হয়ে গেছে। সেই জন্যই হয়তো, পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু কোনও উৎসবেই লৌকিক আচার-আচরণ বা সংস্কৃতির প্রকাশ খুব বেশি বা বলতে গেলে একেবারেই দেখা যায় না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কথা জানি না। তুলনায় অসমে এখনও সাধারণ মানুষের মধ্যে লৌকিক আচার-আচরণ বা লোক সংস্কৃতির প্রভাব এখনও থেকে গেছে। তাই তো সেখানে অসমিয়াদের মধ্যেই হোক বা অসমের বরাক উপত্যকার বাঙালিদের মধ্যেই হোক, উৎসবের লৌকিক রূপ এখনও অক্ষুণ্ণ।

অসমের সর্বজনীন উৎসব বিহুর লৌকিক রূপ শুধু দেখার নয়, এটা অনুভব করতে হয়।

Comments

Popular posts from this blog

GREAT BOYS STOP WARS

প্রেমের একদিন প্রতিদিন