সুভাষ: জীবনী নয় মহাজীবনী

সুভাষ ছিলেন আমার হিরো। এখন আর নয়। আসলে সুভাষকে প্রতিনিয়ত খাটো হতে দেখতে-দেখতে কবে যেন তিনি আমার চোখে নায়কের আসন থেকে সরে গেছেন। আমি কোনও মহাজীবনের ক্ষেত্রে এটা হতে দেখিনি যে, তাঁরা কত মহৎ তা বোঝানোর জন্য অন্য কাউকে খাটো করা হচ্ছে। সুভাষের ক্ষেত্রেই সেটা হতে দেখেছি। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যে কত বড় তা বোঝানোর জন্য অন্যান্য অনেককে প্রতিনিয়িত খাটো করা হয়ে থাকে। এতে উলটে সুভাষকেই খাটো লাগতে শুরু করেছিল আমার। সুভাষ সম্পর্কে একজনের মূল্যায়নই আমার মন টেনেছিল। তিনি হলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। কিন্তু আলী সাহেবের লেখাটা যখন পড়েছিলাম, তখন আমার চিন্তার রাজ্যে এতটাই তোলপাড় হয়ে গিয়েছে যে, সুভাষকে ফের নায়কের আসনে বসানোটা আমার পক্ষে কষ্টকর ছিল।

সুভাষ এখন আর আমার নায়ক না-হলেও তাঁকে ভুলে যাইনি। তাঁকে কি ভোলা যায় কখনও। তাই তো তাঁকে নিয়ে হিন্দিতে যে ম্যাগনাম ওপাস তৈরির প্রয়াস পাওয়া হয়েছিল, সেলুলয়েডে, তার নাম দেখেই আমি খানিক চমকে গিয়েছিলাম— বোস: দ্য ফরগটেন হিরো। এই নামটা পুরোপুরি আমরা ভাবনার উলটো। সুভাষ বসু আমার নায়কও নন, তবে তিনি আমার কাছে বিস্মৃতও নন। তবু সিনেমাটা দেখেছিলাম। কারণ পরিচালকের নামটা ছিল শ্যাম বেনেগল। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার এই সিনেমা দেখার পর মনে পড়ে গেল আমার ছোটবেলার কথা। সেই সময় আমি এ রকম একটা সিনেমাই দেখতে চেয়েছিলাম। ভাবলাম, শ্যাম বেনেগলকে গিয়ে কথাটা বলি। তিনি আমার দু হাত দূরেই দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু সংকোচ হল। সংকোচের বিহ্বলতা, নিজেরই অপমান— এ কথা জানি, তবু বেনেগলের মতো বিশাল মাপের পরিচালকের সামনে গিয়ে কথাটা বলার সাহস হল না।

ছোটবেলায় সুভাষ বসুর জীবনের রোমাঞ্চকর অধ্যায়কে সিনেমার পর্দায় দেখার ইচ্ছেটা জেগেছিল একটা বাংলা সিনেমা দেখার পর। পিযূষ বসু পরিচালিত সেই সিনেমার নাম ছিল সুভাষচন্দ্র। সেই সিনেমায় ছিল সুভাষের শৈশব, কলেজ জীবন, আইসিএস পরীক্ষা পর্ব, তাঁর শুরু দিকের রাজনৈতিক অভিযান, শেষ হয়েছিল পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারিতে। মানে মহানিষ্ক্রমণের ঠিক আগের ঘটনা পর্যন্ত। এই সিনেমারই শুরুতে সেই বিখ্যাত গানটা ছিল- একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি। সিনেমাটা যত ভাল লেগেছিল, ততটাই খারাপ লেগেছিল শেষ হওয়ার পর। কেননা, সুভাষ বসুর জীবনের যে-পর্বটা নিয়ে আমার বেশি আগ্রহ ছিল সেটাই দেখানো হল না।

সেই আশা পূরণ হল, বোস: দ্য ফরগটেন হিরো-তে। সিনেমাটা শুরুই হচ্ছে সুভাষের মহানিষ্ক্রমণের সময় থেকে। আশা তো পূরণ হল, কিন্তু মন ভরল না। আসলে সুভাষের মতো মহাজীবনকে সাহিত্য বা সিনেমায় ধরতে পারাটা জটিল। এটা করতে হলে, এই দুটো মাধ্যমের শিল্প প্রকরণ ও প্রচলিত তত্ত্বকে ভাঙচুর করতে হবে। কেননা, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি গানটা সুভাষচন্দ্র সিনেমায় ব্যবহার তো করা হল, কিন্তু সুভাষ ঘরে ফেরে নাই।

যাঁর জীবন একটা এপিক, তাঁকে নিয়ে বায়োপিক হয় না।   

© তাপস পাল

Comments

Popular posts from this blog

GREAT BOYS STOP WARS

প্রেমের একদিন প্রতিদিন